নাজকা সভ্যতার রহস্যময় ভূ-চিত্র

নাজকা লাইন হলো পেরুর দক্ষিণাঞ্চলের প্যাম্পা কলোরাডো বা লাল সমতলভূমি নামে পরিচিত এলাকার মাটিতে আঁকা কিছু জীব-জন্তু এবং জ্যামিতিক রেখার সমাহার যাদের ইংরেজীতে geoglyph বলা হয়ে থাকে। ১৯২০ এর দশকের শেষভাগে পেরুর রাজধানী লিমা এবং এর দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর আরেকিপার মধ্যে বানিজ্যিক ভাবে বিমান চলাচল শুরু হলে ন্যাসকা লাইনগুলি প্রথম ব্যাপকহারে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষন করতে সক্ষম হয়। সেই সাথে আর্কিওলজিস্ট, এন্হ্রোপোলজিস্ট সহ প্রাচীণ সভ্যতা সম্পর্কে আগ্রহী সকল মানুষকে এক বিশাল ধাঁধার মধ্যে ফেলে দেয়। ছবিগুলো আন্দিজ পর্বত এবং প্রশান্ত মহাসাগর থেকে ৩৭ মাইল দূরে সমান্তারালভাবে প্রায় ১৫ মাইল দীর্ঘ ব্যাপী বিস্তৃত। এই লাইনগুলোকে কখনও ইনকাদের রাস্তা, কখনও চাষাবাদের পরিকল্পনা, আবার কখনও পুরনোদিনের 'হট এয়ার' বেলুন থেকে উপভোগ করার জন্য আঁকা ছবি হিসাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন এগুলি হচ্ছে নাজকাদের মহাকাশীয় ক্যালেন্ডার। এদের মধ্যে সবচাইতে উল্লেখযোগ্য ব্যাখ্যাটি হচ্ছে এরিক ভন দানিকেনের ভিনগ্রহবাসীদের বিমান অবতারনার জন্য বানানো এয়ারস্ট্রীপের ব্যাখ্যাটা

nazca line peru
১৯৯৭ সালে পেরু এবং জার্মান গবেষকদলের সমন্ময়ে প্যালপা শহরের কাছে নাজকা-প্যালপা নামে একটি গবেষণা প্রকল্প শুরু করা হয়। এই গবেষকদল নিয়মতান্ত্রিকভাবে একাধিক বিষয়ভিত্তিক গবেষনা শুরু করেন, যেমন ঐ অঞ্চলের মানুষের জীবন-যাপন পদ্ধতি, কেনইবা তারা হারিয়ে গেল, এই লাইনগুলোর উদ্দেশ্যই বা কি ছিলো। এই গবেষকদলের মতে নাজকা সভ্যতার শুরু এবং শেষ হয়েছে "পানির" সাথে সাথে। পেরুর উপকূলীয় দক্ষিনাঞ্চল এবং চিলির উত্তরাঞ্চল হলো পৃথিবীর অন্যতম শুষ্ক অঞ্চল। আন্দিজ পর্বত থেকে পূর্ব দিকে দশটি নদী নেমে এসেছে যেগুলো বছরের একটা নির্দিষ্ট সময় শুকনো থাকে। এই নদীগুলো দ্বারা গঠিত একটি সুরক্ষিত অববাহিকাতেই ন্যাসকা সভ্যতা বিকশিত হয়েছিলো। বসতির স্হাপনার জন্য এখানকার পরিবেশ ছিলো খুবই উপযুক্ত এবং সেই সাথে ছিলো ঝুঁকিপূর্ন। নাজকার আঞ্চলিক আবহাওয়া খুবই নাটকীয় ভাবে ওঠানামা করে। যখন দক্ষিণ আমেরিকার মধ্যাঞ্চল থেকে "বলিভিয়ান হাই" নামে পরিচিত উচ্চচাপের বায়ুমন্ডল উত্তর দিকে সরে আসে তখন আন্দিজের পশ্চিম ঢালে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। আর যখন সেটা দক্ষিণদিকে দিকে সরে যায় তখন বৃষ্টিপাত কমে যায় ফলে নাজকা অঞ্চলের নদীগুলো শুকিয়ে যায়। ঝুঁকিপূর্ন এই পরিবেশ সত্বেও নাজকা সভ্যতা প্রায় ৮০০ বছর ধরে বিকশিত হয়েছিলো।
খৃষ্টপূর্ব ২০০ সালের দিকে আরও পুরোনো সভ্যতা প্যারাকাস থেকে নাজকাদের আবির্ভাব হয়। এরা নদী অববাহিকায় বসতি স্হাপন করে কৃষিকাজ করতে শুরু করে। ঐ সময় নাজকাদের ধর্মীয় কান্ড-কারখানার কেন্দ্র ছিলো কাহুয়াচি বলে একটি যায়গা। ১৯৫০ সালে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উইলিয়াম ডানকান স্ট্রং প্রায় ৩৭০ একর এলাকা জুড়ে এই এলাকাটির খনন কার্য চালিয়ে মাটির তৈরী পিরামিড, বেশ কয়েকটি বড়বড় মন্দির, প্রশস্ত বাজার (প্লাজা), প্লাটফরম, পরস্পর সংযুক্ত সিড়ি, এবং করিডোরের একটি নেটওয়ার্ক খুঁজে পান। কাহুয়াকির ৯ মাইল পূর্বে ন্যাসকা নদী মাটির অভ্যন্তরে ঢুকে গিয়ে হঠাৎ করেই আবার কাহুয়াচির পাদদেশে ঝর্নার মত মাটির নীচ থেকে আবির্ভূত হয়েছে। এই স্হানে পানির এই হঠাৎ মাটির নীচ থেকে আবির্ভূত হওয়াটাকে নিঃসন্দেহেই সেই প্রাচীন আমলে ঐশ্বরিক ভাবা হত বলে ভাবা হত।

নাজকার অন্যান্য জায়গার মানুষেরা নদীর পূর্ব এবং পশ্চিম তীর ধরে বৃষ্টিপাতের ধরণের উপর নির্ভর করে বসতি স্হানান্তর করত। প্রশান্ত মহাসাগরের তীর থেকে শুরু করে আন্দিজ পর্বতমালার ১৫০০০ ফুট উচ্চতা পর্যন্ত গবেষকরা যেখানেই খুড়েছেন সেখানেই নাজকা বসতির প্রমাণ খুঁজে পেয়েছেন। আর প্রতিটা বসতির পাশেই পাওয়া গেছে বিভিন্ন ধরেণের ভূ-চিত্র। উঁচু মরুভুমি এবং পাহাড়ের ঢাল ছিলো ছবি আঁকার জন্য উৎকৃষ্ট ক্যানভাস। নাজকা অঞ্চলের মরুভূমিতে কোন বালি নাই, উপরের সারফেস মূলত পাথর দ্বারা গঠিত। ছবিগুলো তৈরী করার জন্য উপরের গাঢ় লাল রঙের পাথর এবং মাটি সরিয়ে ফেলা হয়েছে। নিচের হালকা রঙের মাটিই এই লাইনগুলোকে আসলে আকৃতি দিয়েছে। জলবায়ূ আদ্র হওয়ায় কারণে পাথরগুলি মরচে পরার মত গাঢ় রঙ ধারণ করেছে যা আবার পাথরগুলোকে তাপ ধরে রাখতে সাহায্য করে। শুষ্ক, বৃস্টিপাতহীন মরু আবহাওয়ায় এই লাইনগুলির তেমন একটা ক্ষয় হয় না বল্লেই চলে। আর সে কারণেই বহু শতাব্দী পরেও এই ভূ-চিত্রগুলি আজও মোটামুটি অক্ষত অবস্হায় আছে। প্রত্নতত্ববিদরা মনে করেন এই রেখাগুলির সৃষ্টি এবং রক্ষনাবেক্ষন উভয়ই ছিলো একটি গোষ্ঠিগত প্রচেষ্টা। অনেকটা আগের দিনে খৃস্টানদের 'ক্যাথিড্রাল' বানানোর মত।

বেশিরাভগ মানুষের কাছেই নাজকা মানেই হলো এর লাইনগুলি। কিন্তু নিশ্চিত করেই বলা যায় যে নাজকারা ভূ-চিত্র অংকনে খুবই প্রসিদ্ধ হলেও তারাই প্রথম এ ধরণের ছবি আঁকেনি। প্যালপা এলাকার নাজকাদের পূর্ববর্তী প্যারাকাস সভ্যতার লোকেরাও মোট ৭৫টি ভিন্ন ধরণের/গ্রুপের ভূ-চিত্র এঁকে গেছে। এই প্যারাকাস ভূ-চিত্রগুলোর মধ্যে মানুষের দৈহিক ছবির আধিক্য দেখা যায়। যেগুলো কিনা আবার আরও প্রাচীণ কালের পাথরে খোদাই করা পেট্রোগ্লিফ নামে পরিচিত চিত্রের বৈশিষ্ট্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ন। এই পেট্রোগ্লিফগুলো থেকে নাজকা লাইন সম্পর্কে একটা গুরুত্বপূর্ন তথ্য পাওয়া যায়, আর সেটা হলো এগুলো নির্দিষ্ট কোন এক সময়ে বা এক স্হানে বা একই উদ্দেশ্য নিয়ে আঁকা হয়নি। এদের বেশির ভাগই পুরনো কোন ছবির উপর নতুন করে আঁকা। এভাবে বারবার মুছে আবার তার উপর আঁকার কারণে ছবিগুলোর মানে খুঁজে বের করাটাও হয়ে পরেছে অনেক কঠিন।

শুধু আকাশ থেকে দেখতে পাওয়ার জনপ্রিয় ধারণাটাও আসলে আধুনিককালের অতিকথন। নাজকাদের আগের প্যারাকাস যুগের পাহাড়ের গায়ে আঁকা ভূ-চিত্রগুলো প্যাম্পা থেকে দেখতে পাওয়া যায়। ন্যাসকা সভ্যতার শুরু দিকে মানুষের ছবির বদলে প্রাকৃতিক ছবির আধিক্য বেড়ে যেতে থাকে এবং সেগুলো পাহাড়ের ঢাল থেকে সমতলভূমিতে স্হানান্তরিত হতে থাকে। এই খোদাইকৃত স্পাইডার, হামিংবার্ড সহ বেশীরভাগ প্রানীর ছবিগুলোই একলাইনে আঁকা। কেউ একজন এই ছবিগুলোর যে কোন এক স্হান থেকে শুরু করে অন্য কোন লাইনকে অতিক্রম না করেই অন্য আরেক স্হানে বের হয়ে যেতে পারবে। প্রত্নতত্ববিদরা মনে করেন নাজকা সভ্যতার প্রথমদিকেই এগুলো শুধুমাত্র ছবি থেকে উৎসবীয় শোভাযাত্রার পায়ে হাটা পথে রুপান্তরিত হয়। পরবর্তীকালে জনসংখ্যা বেড়ে গেলে আরও বেশিসংখ্যক লোক এই ধর্মীয় আচারে অংশ নিতে শুরু করলে এই ভূচিত্রগুলো আরও অনেক উন্মুক্ত এবং জ্যামিতিক আকার ধারণ করতে শুরু করে। গবেষকদের মতে তখন এগুলোকে আর শুধু ছবি হিসাবে তৈরী করা হতো না বরং এগুলো ছিলো ধর্মীয় উৎসব পালনের জন্য ব্যবহৃত হাঁটার মঞ্চ। গবেষকরা ঐ সমস্ত ভূ-চিত্রের আশে পাশে, বিশেষ করে মূল মঞ্চের আশে পাশে, চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের সুক্ষ পরিবর্তন থেকে বুঝতে পেরেছেন যে ওখানকার মাটি মানুষের হাঁটা-চলা বা অন্যান্য কর্মকান্ডের ফলেই সৃষ্টি হয়েছে। গবেষকদের তথ্য অনুযায়ী ট্টাপিযয়েড এবং অন্যান্য জ্যামিতিক আকার গুলো এমন যায়গায় তৈরী করা হয়েছে যাতে করে সেগুলো ভিন্ন ভিন্ন সুবিধাজনক স্হান হতে দেখা যায়। এসব তথ্য থেকে গবেষকরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে এই স্হানে বিভিন্ন দল বিভিন্ন ধরণের কর্মকান্ড করত আর যা দূরে উপত্যাকা থেকে বা অন্যান্য ভূ-চিত্রের উপর থাকা মানুষজন সেগুলো অবলোকন করতে পারত।


বহু শতাব্দী ধরে আন্দিজের অধিবাসীরা পাহারের গায়ে আঁকা বিভিন্ন দেবতাদের কাছে প্রার্থনা করত, যেমন সেরো ব্ল্যাঙ্কো। আর ঐতিহ্যগত ভাবেই পাহাড়কে পৌরাণিক কাহিনীর মত সাধারণতঃ পানির উৎসের সাথে সম্পর্কযুক্ত মনে করা হয়। ন্যাসকা লাইনগুলোর মূল উদ্দেশ্যই ছিলো সেরো ব্ল্যাঙ্কো সহ অন্যান্য পাহারের গায়ে খোদাইকৃত দেবতাদের কাছে প্রার্থনা করা। বৃষ্টপাত শুরু হওয়া এবং কৃষিকাজ ও উর্বরতার সাথে সম্পর্কিত বহু ধর্মীয় আচার পালনের চিহ্ন গবেষকরা এই স্হানগুলোতে, বিশেষ করে বেদীর আশেপাশে পেয়েছেন। এ চিহ্নগুলো ছিলো ধর্মীয়ভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ন এবং পানি এবং উর্বরতার প্রতীক এবং পানির জন্য প্রার্থনার সাথে সম্পর্কযুক্ত। গবেষকদলের মতে পানি ছিলো নাজকা অঞ্চলের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ন একটা বিষয়।


ভূ-গর্ভস্হ পানি সংরক্ষনের জন্য নাজকাদের তৈরী বিশেষ ধরনের আকিফার'স। 
nazca water
কিন্তু এতসব প্রার্থনা এবং নৈবেদ্যর সবই বিফলে গেছে। ৫০০ থেকে ৬০০ খৃষ্টাব্দের মধ্যে পানির স্বল্পতা কিংবা অনুপস্হিতিই যে নাজকা সভ্যতার বিলুপ্তির অন্যতম প্রধান কারণ ছিলো সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নাই। নাজকাদের বসতি স্হাপনার ক্রম ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায় যে তারা যেন শুষ্ক জলবায়ুকে দৌড়ে পরাজিত করতে চেয়েছিলো। ৬ষ্ঠ শতাব্দীর শেষের দিকে শূষ্ক জলবায়ুর জয় হয় এবং নাজকা সভ্যতার পতন ঘটে। কাহুয়াচির আশেপাশের নাজকা সংস্কৃতির পতনের কারণ যে শুধুমাত্র আবহাওয়া ছিলো তা নয়। কিছু কিছু উপত্যাকায় পানির পরিমাণ বেশী থাকায় আশে পাশের গোত্রগুলির মধ্যে সংঘাতের পরিমাণও অনেক বেশী বেড়ে যায়। ৬৫০ খৃষ্টাব্দের দিকে মধ্যাঞ্চলের উচ্চভূমি থেকে ছড়িয়ে পরা যুদ্ধবাজ গোত্র Wari / Huari রা দক্ষিণের মরুভূমি অঞ্চলের নাজকাদের বিলীন হওয়ারও কারণ হয়ে দাড়ায়।

আজকের দিনে নাজকাদের ঐতিহ্য যদিও তাদের লাইনগুলির মাধ্যমেই আজও বেঁচে আছে এবং বেশিরভাগ মানুষ তা আকাশ থেকেই অবলোকন করে থাকে তথাপি মাটিতে লাইনগুলির উপর দিয়ে না হাটলে সেগুলোর আসল গুরুত্ব অনুধাবন করা যায় না বলেই গবেষকদের মতামত। মূল লেখকের মতে প্রার্থনার জন্য এই লাইনগুলির উপর দিয়ে হাটার ফলে ন্যাসকা মানুষদের নিজেদের মধ্যকার আত্মিক এবং সামাজিক বন্ধন আরও দৃড় হত। এই ভূচিত্র গুলো নাজকাদের বহমান জীবন এবং ধর্মীয় আচারের মাধ্যমেই স্মরণ করিয়ে দিত যে তাদের ভাগ্য তাদের পরিবেশের সাথেই বাঁধা। এই ভূ-চিত্র গুলো থেকেই ভালো এবং খারাপ উভয় সময়েই প্রকৃতির প্রতি তাদের অকৃত্রিম ভালবাসার প্রমাণ পাওয়া যায়।
আরো অসংখ্য ছবি আছে গুগলে Nazca line লিখে সার্চ দিন পেয়ে যাবেন।

Post a Comment

জানার অধিকার সবার আছে। তাই নিজে জানুন অন্যকে জানান। শেয়ার করুন আপনার পরিচিতদের সাথে এবং আপনার মতামত লিখে জানান