পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাওয়া হ্রদ ভোস্টক

আমাজনের গভীর জঙ্গলে পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন অন্য এক জগত। আদিম সে যুগের পৃথিবীতে , ডাইনোসর, টেরোড্যাকটাইল, ইগুয়ানোডন দের রাজত্ব। প্রফেসর জর্জ এডওয়ার্ড চ্যালেঞ্জার আবিস্কার করলেন সে জগত। সেই হারানো জগত নিয়ে রচিত কল্প বিজ্ঞান উপন্যাস The Lost Wrold । এক নিশ্বাসে পড়ে ফেলার মত এ বই স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের লেখা।

lake vostok
 এই অল্প কিছুদিন আগে রাশিয়ার বিজ্ঞানীরা আবিস্কার করলেন অন্য এক হারানো জগত, নাম তার লেক ভোস্টক। কোন কল্পকাহিনী নয়, বাস্তব এক হারানো জগৎ লেক ভোস্টক। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৯ কিলোমিটার উচু এভারেস্ট চুড়া থেকে শুরু করে প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরতম স্থান ১১ কিলোমিটার গভীর মারিয়ানা ট্রেঞ্চ এ মানুষের পা পড়েছে অনেক আগেই।এতদিন মানুষের দৃস্টির বাইরে থেকে যাওয়া হ্রদ হল লেক ভোস্টক।
lake vostok
রাশিয়ান শব্দ ভোস্টকের অর্থ হল পূর্ব বা পূব। চির তুষারের মহাদেশ আন্টার্কটিকা। দক্ষিন মেরুর এই মহাদেশের অন্যতম আবিস্কারক রাশিয়ার অভিযাত্রী এডমিরাল ফাবিয়ান ভন বেলিঙ্গহোসেন ( Admiral Fabian von Bellingshausen) যে জাহাজে করে আন্টার্ক্টিকাতে পৌছেন তার নাম ছিল ভোস্টক। তার সে জাহাজের নাম অনুসারে এবং পূর্ব আন্টার্কটিকাতে স্থাপিত হল রাশিয়ান বেস স্টেশান “ ভোস্টক”. এখানেই রেকর্ড করা হয় ভূ পৃষ্ঠের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নীচে ৮৯ ডিগ্রী সেলসিয়াস ১৯৮৩ সালের ২১ শে জুলাই। বসবাসের অনুপযোগী চরম বৈরী আবহাওয়ার এ স্টেশানের লোকদের নির্ভর করতে হয় ১০০০ কিলোমিটার বরফের উপর পাড়ি দিয়ে আসা ট্রাক্টরের উপর।
একসময় ধারনা করা হত যে মেরুপ্রদেশের সব পানিই বরফ হয়ে হয়ে আছে। বরফের নীচে হ্রদ থাকার সম্ভাবনার কথা প্রথম বলেন রাশিয়ান বিজ্ঞানী আন্দ্রে কাপিৎসা। ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত রাশিয়ান মেরু অভিযানের অংশ হিসেবে বিজ্ঞানী কাপিৎসা মেরপ্রুদেশের বরফের স্তর আল্ট্রাসাউন্ড দিয়ে পরীক্ষা করেন। বরফের নীচের পানির পৃষ্ঠ এবং পানির নীচের স্থলভাগ, এই দুই স্তর থেকে আল্ট্রাসাউন্ডের ফিরে আসা লক্ষ করেন কাপিৎসা।

এরপর ১৯৭০ সালের দিকে বৃটেনের বিজ্ঞানীরা বিমানের রাডারের সাহায্যে মেরুর বরফের স্তর পরীক্ষা করে বরফের নীচে হ্রদ থাকার সম্ভাবনাকে আরো জোরদার করেন। ১৯৯১ সালে বৃটেনের উপগ্রহ ই আর এস-১ উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সীর তরংগ দিয়ে মেরুপ্রদেশের বরফ স্তর পরীক্ষা করে বরফের নীচে হ্রদ থাকার সম্ভাবনার কথা বলেন।
আন্টার্কটিকাতে এ পর্যন্ত ৩৫০ টির ও বেশী বরফের নীচে থাকা হ্রদ চিহ্নিত করা হয়েছে, হয়ত আরো আবিস্কার হবে । প্রায় ২০ বছর ধরে ৪ কিলোমিটার পুরু বরফের স্তর খনন শেষে গত ৫ই ফেব্রুয়ারী ২০১২ সালে লেক ভোস্টকের পানি পৃষ্ঠে পৌছেন রাশিয়ান বিজ্ঞানীরা। এই প্রথম কোণ বরফের ণিচের হ্রদপৃষ্ঠে পৌছালেন বিজ্ঞানীরা। একে ১৯৬৯ সালে চাঁদের বুকে মানুষের প্রথম পদক্ষেপের সাথে তূলনা করেন রাশিয়ান আর্কটিক এবং আন্টার্কটিক গবেষনা ইনস্টিটিউটের (AARI) বিজ্ঞানী ভ্যালেরী লুকিন।
মেরু প্রদেশে ৬ মাস গ্রীষ্ম আর ৬ মাস শীতকাল। আন্টার্কটিকাতে আর অল্প কিছুদিন পর শুরু হবে শীতকাল । শীতকালে খনন কাজ চালানো সম্ভব হয় না বিধায় বিজ্ঞানীরা ফিরে যাবেন ।আগামী গ্রীস্মে পূনরায় শুরু করবেন অভিযান। এর মধ্যেই তারা পৌছলেন হ্রদ ভোস্টকের পানিতে।
লেক ভোস্টক- ২৫০ কিলোমিটার লম্বা আর সর্বোচ্চ ৫০ কিলোমিটার চওড়ার এ হ্রদের আয়তন ১৫,০০০ বর্গ কিলোমিটার। এর আয়তন কানাডার টরোন্টো শহরের পাশের লেক ওন্টারিওর আয়তনের সমান হলেও এখানে পানির পরিমান কিন্তু লেক ওন্টারিওর তিনগুন। এর গড় গভীরতা ৩৪৪ মিটার আর দক্ষিন এবং উত্তর বেসিনে ভাগ । উত্তরের বেসিনের গভীরতা সর্বোচ্চ ৪০০ মিটার আর দক্ষিনের ৮০০ মিটার পর্যন্ত। ধারনা করা হচ্ছে যে বরফের নীচের হ্রদ্ একটার আস্থে অপরটা নদী দিয়ে সংযুক্ত।
এখানে পানি থাকা সম্ভব কিভাবে?
কারন দুটো ১) ৪ কিলোমিটার পুরু বরফের স্তরের চাপে নীচের তাপমাত্রা বেড়ে যায় ২) জিওথার্মাল বা ভূগর্ভের তাপে বরফের নীচের স্তর গলে তাপরিনত হয় পানিতে।
হ্রদের উতপত্তি- সম্ভাবনা দুটো ১) আজ থেকে সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে আন্টার্কটিকা ছিল উষ্ণ মহাদেশ । ক্রমশ ঠান্ডা হতে হতে উপরের স্তর বরফে রুপান্তরিত হলেও নীচের স্তর পানি হিসেবে থেকে যায়।২) দ্বিতীয় সম্ভাবনা হল বরফের নীচুর দিকে গলে যাওয়ার ফলেই হ্রদের উৎপত্তি। যদি উৎপত্তির প্রথমটিকে সম্ভাব্য কারন হয় তাহলে দেড় কোটি বছর আগের প্রানীর দেখা মিলবে এই হ্রদের পানীতে। আর যদি বরফের নীচের স্তর গলে যাওয়ার ফলে উৎপত্তি হয়ে থাকে এ হ্রদের তাহলে এখানে প্রানের সম্ভাবনা কম। এখানে যদি প্রানী খুজে পাওয়া যায় তাহলে ভিনগ্রহ যেমন ইউরোপার বরফের স্তরের নীচে প্রানের অস্তিত্বের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে।
এ হ্রদের পৃষ্ঠের চাপ বায়ুমন্ডলের চেয়ে ৩৫০গুন বেশী। এর পানিতে অক্সিজেন এবং নাইট্রোজেনের মাত্রাও ও অত্যধিক, ভূপৃষ্ঠের যে কোন হ্রদের পানির তুলনায় ৫০ গুন বেশী ।
হ্রদের বয়স ধারনা করা হয় দেড় কোটি বছর। অনেকে ধারনা করেন এর বয়স আরো বেশী ৩ কোটী বছর। এই দেড় কোটি বছর ধরে বরফের স্তরের নীচে ঢাকা পড়ে আছে হ্রদ । দেড় কোটী বছর আগে কেমন প্রানী বাস করতো পৃথিবীতে সে সম্পর্কে ধারনা পাওয়া যেতে পারে এই হ্রদের পানি থেকে। বৃহস্পতির উপগ্রহ ইউরোপাতে একই ধরনের বরফের স্তর আবিস্কৃত হয়েছে বেশ কয়েক বছর। সেখানকার প্রানী জগত সম্পর্কে ধারনা পাওয়া যেতে পারে এই হ্রদের পানি বিশ্লেষন করলে। বিজ্ঞানীদের ধারনা এই হ্রদের পানীতে জীবানু শ্রেনীর কিছু প্রানীর সন্ধান মিলতে পারে। আগামী ডিসেম্বরের দিকে এর পানীতে রোবট দিয়ে হ্রদের তলদেশ এবং পানির নমুনা সগ্রহের চিন্তা করছেন রাশিয়ার বিজ্ঞানীরা। এখানকার প্রাপ্ত তথ্য থেকে পৃথিবী এবং প্রানীর উৎপত্তি সম্পর্কে ধারনা মিলবে –এমন আশা বিজ্ঞানীদের।

Post a Comment

জানার অধিকার সবার আছে। তাই নিজে জানুন অন্যকে জানান। শেয়ার করুন আপনার পরিচিতদের সাথে এবং আপনার মতামত লিখে জানান